পথহারা পথিকের কথা
দেশে করোনা ভয়ংকর আকার ধারণ করছে, এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে, মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানা, অবাধে যাতায়াত, ভারতে যাওয়া-আসা, দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আম পরিবহনে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়াসহ আরও স্বীকৃত ও কথিত অনেক কারণ রয়েছে।
এ বছর করোনার প্রকোপ রোধে প্রথম লকডাউন দেয়া শুরু হয় ১৪ এপ্রিল থেকে। সে সময় লকডাউন করোনার বিস্তার ঠেকাতে কিছুটা হলেও সফল হয়। ২৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায় করোনায় একদিনে মারা গেছে ৮৮ জন, ওই সময়ে আক্রান্ত হয়েছে ৩ হাজার ৬শ’ ২৯জন। শনাক্তের হার ১৪ শতাংশ। এর আগের দিন মৃতের সংখ্যা ছিল ৯৮জন, মোট শনাক্ত ৪ হাজার ১৪জন, শনাক্তের হার ১৪.৬৩। আগের দিনের পর্যায়ক্রমে এ সংখ্যাগুলো হচ্ছে মৃত্যু ৯৫জন, আক্রান্ত ৪ হাজার ২শ’ ৮০জন, শনাক্তের হার ১৫.০৭। মৃত্যু ৯১জন, শনাক্ত ৪ হাজার ৫শ’ ৫৯জন, শনাক্তের হার ১৬.৮৫। মৃত্যু ১১২ জন, শনাক্ত ৪ হাজার ২শ’ ৭১জন, শনাক্তের হার ১৭.৬৮, মৃত্যু ১০২, শনাক্ত ৩ হাজার ৬শ’ ৯৮ জন, শনাক্তের হার ১৯.৬। মৃত্যু ১০১, শনাক্ত ৩ হাজার ৪শ’ ৭৩ জন শনাক্তের হার ২১.৪৬। মৃত্যু ১০১জন, শনাক্ত ৪ হাজার ৪শ’১৭, শনাক্তের হার ২৩.৩৬। মৃত্যু ৯৪, শনাক্ত ৪ হাজার ১শ’৯২জন, শনাক্তের হার ২১। মৃত্যু ৯৬, শনাক্ত ৫ হাজার ১শ’ ৮৫, শনাক্তের হার ২০.৮৯ শতাংশ।অর্থাৎ যেদিন ‘কঠোর লকডাউন শুরু হয় সেদিন শনাক্তের যে হার ছিল ( ২০.৮৯ শতাংশ) তা ১০ দিনে অনেক কমে ২৩ এপ্রিলে দেয়া তথ্যে শনাক্তের হার নেমে আসে ১৪ শতাংশ। এই সময়ে আক্রান্তের হার নিয়মিতই কমেছে, অবশ্য এ সময়টাতে মৃত্যুর সংখ্যা খুব বেশি হেরফের হয়নি, এ সময়টাতে সর্বনিম্ন মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৩ এপ্রিল, ৮৮ জন আর সর্বোচ্চ ছিল ১৯ এপ্রিল ১শ’১২জন।
এরপর ধীরে ধীরে শিথিল ও স্তিমিত হয়ে যায় লকডাউন। ফের বাড়তে থাকে শনাক্ত আর মৃতের সংখ্যা। জুনের ১৬ তারিখ স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায় করেনায় মারা গেছে ৬০ জন আর শনাক্ত ৩ হাজার ৯শ’ ৫৬জন, ১৭ জুন মৃতের সংখ্যা ছিল ৬৩, শনাক্ত ৩ হাজার ৮শ’ ৪০, ১৮ জুন ৫৪ জনের মারা যাওয়ার তথ্য দেয়া হয়, শনাক্ত ৩ হাজার ৮শ’ ৮৩। ২৯ জুন ১১২ জনের মৃত্যুর ও ৭ হাজার ৬শ’ ৬৬ জনের শনাক্ত, ৩০ জুন ১১৫জন মৃত্যু, ৮ হাজার ৮শ’ ২২জন শনাক্ত, ১ জুলাই ১৪৩জনের মৃত্যু ও ৮ হাজার ৩শ’ ১ জনের শনাক্ত এবং ২ জুলাই ১৩২ জনের মারা যাওয়ার ও ৮ হাজার ৪শ’ ৮৩ জনের শনাক্তের তথ্য দেয় স্বাস্থ্য অধিদফতর।
২৩ এপ্রিল দেশে শনাক্তের হার বলা হয় পরীক্ষা অনুপাতে ১৪ শতাংশ, ওই দফায় লকডাউন শুরুর দিনটিতে অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল শনাক্তের হার ছিল ২০.৮৯ শতাংশ। এরপর আবার সবকিছু স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করে, আর বাড়তে থাকে মৃত্যু ও শনাক্ত। দেশে সবচে’ বেশি ১৪৩ জনের মারা যাওয়ার তথ্য দেয়া হয় ১ জুলাই, আর শনাক্ত ৩০ জুন ৮ হাজার ৮শ’ ২২জন। সবচে’ বেশি শনাক্তের হারের তথ্য দেয়া হয় ২ জুলাই ২৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। দেখা যাচ্ছে এপ্রিল থেকে জুনে মৃত্যর সংখ্যা, মোট শনাক্ত আর শনাক্তের হার বেড়েছে দ্বিগুণ বা তারও বেশি।
চলমান কঠোর লকডাউন কার্যকরে (সরকারি ভাষায় কঠোর বিধি-নিষেধ) পুলিশের পাশাপাশি নামানো হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও সেনাবাহিনী। এবারের লকডাউন মানুষের মধ্যে চরম অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে, কেন না ১৫ মাস ধরে চলা লকডাউন বা বিধি নিষেধে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু প্রায় বন্ধ। যানবাহন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল, মানুষ যখন কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে তখনই এলো কঠোর লকডাউন।
কিন্তু করোনায় মৃত্যু আর শনাক্তের ক্ষেত্রে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে তাতে মানুষকে ঘরে আটকে রাখা ছাড়া সরকারেরই বা কি করার আছে? তবে কঠোর লকডাউনে গার্মেন্টস খোলা রাখাসহ কিছু কিছু পদক্ষেপের কারণে মানুষের মধ্যে এ ধারণা জোরদার হচ্ছে সরকার আসলে চাপের মুখেই এসব করছে। এটা ঠিক যে গার্মেন্টস দেশের সবচে’ বড় রফতানিখাত, কর্মসংস্থানের বিচারেও এটি উপরের দিকে থাকবে, এ খাতটি সচল রাখা নিয়ে মানুষের আপত্তি নেই, তবে অন্য খাতগুলো সচল রাখতেও সরকারের বিকল্প চিন্তা করা উচিত।
যানবাহন বন্ধ না রেখে ‘সীমিত’ কথাটা প্রকৃত অর্থেই ‘সীমিত’ করা যায়। ট্রেনে অর্ধেক যাত্রী বহন করার বিষয়টি বেশ সফলভাবেই কার্যকর করা গেছে, বাসের ক্ষেত্রে তা মানানো যায়নি, লঞ্চের ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য, কিন্তু তা করা কি অসম্ভব?
সরকার চাইলে এটা মোটেও কঠিন কিছু না। সরকারের নির্দেশে যদি গাড়ি আর লঞ্চ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাহলে সরকারের নির্দেশ ও নির্দেশনায় তা স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সীমিত আকারে সচল রাখাটা কেন অসম্ভব হবে?
লঞ্চগুলো ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী ওঠা নিশ্চিত করেই ছাড়া সম্ভব। যতটা সম্ভব অনলাইনে টিকিট দেয়া হলে মানুষ টিকিটের জন্য হুড়াহুড়ি করবে না, বাসের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আসনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চালু রাখা প্রশাসনের জন্য অসম্ভব কিছু না। লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চ ছাড়ার যে ছাড়পত্র দেয়া হয় তা দেয়া হবে অর্ধেক যাত্রী নিশ্চিত হওয়ার পর। যদি বেশি যাত্রী কোন লঞ্চে থাকে, তাদের নামিয়ে দিতে হবে, বাসেও তাই করা হবে, পথিমধ্যে যদি কেউ ওঠে বা উঠানো হয় তাহলে পরবর্তী চেকপোস্টে তাকে নামিয়ে দেয়া হলে কেউই অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে বাসে উঠবেন না। লঞ্চ আর বাসের টিকিট ২/৩ দিন আগে মোবাইল ফোনে নিশ্চিত করা যায় এসএমএস এর মাধ্যমে। তাতে ভ্রমণের তারিখ ও সময় বলা থাকবে, লঞ্চ ঘাটে মানুষ যাবে লঞ্চ ছাড়ার সর্বোচ্চ দুই ঘন্টা আগে, আর বাস স্টেশনে থাকতে হবে অন্তত ১৫ মিনিট আগে। যখনকার লঞ্চ বা গাড়ি তখনই ছাড়তে হবে, এ ক্ষেত্রে কোন কারণ দেখিয়ে সময়ের হেরফের করা যাবে না।
ফেরিঘাটের আধা কিলোমিটারের মধ্যে মানুষের হাটাচলা নিষিদ্ধ করা ( ঘাট ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বাদে) হলে ফেরিতে উঠে লুটোপুটি খাবে না মানুষ।
তাই আবারও বলি, জীবন বাঁচাতে মানুষের চলাফেরা অবশ্যই সীমিত করতে হবে, সরকারকে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে, তবে কঠোর বিষয়টি শিথিল হতে হতে যাতে একেবারে আলগা না হয়ে যায় তা নিশ্চিত করতেই সবকিছু কিছুটা হলেও সচল ও স্বাভাবিক রাখতে হবে। মনে রাখা ভালো, সবকিছু বন্ধ রাখার চেয়ে কিছু সচল রাখা উত্তম, গ্রহণযোগ্য ও টেকসই সমাধান।