মায়ের ঔষুধই ভরসা
দুইদিন হলো বনে ডয়েচে ভেলের আয়োজনে গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের কনফারেন্সে যোগ দিতে এসেছি।
এ নিয়ে বনে আমার দ্বিতীয়বার আসা। একই কারনে প্রথমবারও আসা হয়েছিল।
একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান ও সিইও আব্দুস সালাম সাহেব এসেছেন আমার একদিন পর। রাতেই তার সাথে দেখা করে আসি হিলটন হোটেলে। কনফারেন্স নিয়ে নানান কথাবার্তা হলো। উনি এবারও একটি সেশনে কী-নোট পেপার পড়বেন। বাংলাদেশের মিডিয়া নিয়ে তার প্রবন্ধ। বিভিন্ন পয়েন্ট নিয়ে অনেক আলোচনা করলেন,মতামত জানতে চাইলেন। তাৎক্ষনিক মতামতের ভিত্তিতে কিছু পরিবর্তন ও পরিমার্জন করলেন। আমার মতন ক্ষুদ্র মানুষের মতামত যে তিনি এতো গুরুত্ব দিবেন, তা কল্পনায়ও ছিল না।
পরের দিন কনফারেন্স শেষে চলে যাই রাইন নদীর তীরে।ইউরোপের অন্যতম বড় নদী হচ্ছে রাইন। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ফ্রাংকফুট, বার্লিন ও মাইনজের কোল ঘেষে বয়ে যাওয়া রাইনের রূপ,সৌন্দর্য দেখার। এবার বন থেকেও দেখা হলো।
রাইন নদীর দু’পাড়ই পাথরে বাঁধানো । চারিদিক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন, নিরিবিলি। নাম না জানা বড় বড় গাছের নীচে কাঠের বেঞ্চি পাতা। এখানে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা ক্লান্ত হলে একটু জিরিয়ে নিতে পারেন।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চিতে বসতেই রাইনের বুক ছুঁয়ে অাসা শীতল হাওয়ায় গা জুড়িয়ে যায়। দূরে ছিমছাম শান্ত নদীর বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট বোট। দু’একটা মাঝারি মালবাহী জাহাজ। নীল জলরাশির ওপর তখন পড়ন্ত বিকেলের সুর্যাস্তের লালচে আভার বিকিরণ, কি যে মায়াময় দৃশ্যচিত্র তৈরি করে। এই সৌন্দর্য অবলোকন করা ছাড়া ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ফেরার পথে ঢুঁ মারি বন থিয়েটার ইনস্টিটিউটে। আসলে থিয়েটার হল দেখাটাই ছিল মুল উদ্দেশ্য । কিম্ত বিধিবাম , সংস্কারের জন্য বেশ কিছুদিন যাবত ইনস্টিটিউটটি বন্ধ। কি আর করা, দুধের স্বাদ ঘোলে মিটাই বাহিরে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছবি তুলে।
থিয়েটার ইনস্টিটিউট হতে আমার হোটেল মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথের দুরত্ব। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও তাড়াহুড়ো নেই ফেরার। এলোমেলো ঘোরাফেরা করি। রাতের বন শহরটি একদমই ফাঁকা, সুনশান নিরবতায় ডুবে আছে। অনেকটাই আমাদের মফস্বল শহরের মতন সন্ধ্যা না হতেই যেন ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরের দিন গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামের সমাপনী অধিবেশন ছিল।চেয়ারম্যান স্যারের সাথে খুব ব্যস্ততায় সারা সকাল দুপুর কেটেছে। লাঞ্চের পর বেঞ্জামিন ইফেরের সাথে পূর্ব নির্ধারিত মিটিং ছিল। শিলার ল্যাংগুয়েজ স্কুলের ক্যাম্পাসে যেতে যেতে ফোনে কথা হয় স্কুলবন্ধু মিল্টনের সাথে। এবারও কেন তার বাসায় উঠিনি এ নিয়ে দারুন অভিমান ও অভিযোগ। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই তার বাসায় থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়ায় শান্ত হলো।
শিলার ল্যাংগুয়েজ স্কুলের ডিরেক্টর বেঞ্জামিন ইফের আমার পুর্ব পরিচিত। ঢাকায় ওর সাথে দু’বার দেখা হয়েছে। একুশে টেলিভিশনে এসেছিল আমার প্রযোজিত একুশে দুপুর অনুষ্ঠানে। বনে প্রথমবার ডয়েচে ভেলের প্রোগ্রামে যখন এসেছিলাম তখনও তার সাথে দেখা করেছিলাম । খুবই ভাল মনের মানুষ ইফের। তার আন্তরিকতা ও আথিতিয়েতা মনে রাখার মতন।
বেঞ্জামিন ইফেরের সাথে সাক্ষাত ও মিটিং সেরে এখানে পড়তে আসা মিনহাজকে বলি, আমাকে বন ইউনিভার্সিটি দেখাতে নিয়ে যেতে হবে।
চলেন,আমাদের সাথে। ক্যাম্পাসের সবুজ মাঠে প্রতিদিনই আমরা ফুটবল খেলি।
ওয়াও। বলো কি তোমাদের এতো ব্যস্ততার মাঝে ফুটবল খেলার সময় হয়?
হ্যাঁ, বিকেলে আমাদের কোন কাজ থাকে না। সবাই মাঠে চলে আসে। একসাথে ফুটবল, ক্রিকেট খেলি।
মিনহাজ, বাবু, হাসানদের সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটেই চলে আসি বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে। সবুজ প্রান্তরের মাঝে বিশাল আয়তন নিয়ে ক্যাম্পাস।রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে অপূর্ব লাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষের পুরানো ভবনটি।
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনো করেছেন মহামতি কার্ল হাইনরিশ মার্কস। তিনি সমগ্র মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের একজন ছিলেন। তাই খুব আগ্রহ ছিল তার স্মৃতি বিজড়িত বন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার। গতবার এসে একনজর দেখেছিলাম,ব্যস্ততার কারনে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা হয়নি।
১৮১৮ সালে প্রুশিয়ান রাজা তৃতীয় ফ্রেডরিশ উইলিয়াম প্রতিষ্ঠা করেন এই বিশ্ববিদ্যালয়টি৷ পরে তার নামানুসারেই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয়। বন বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। গর্ব করার মতন একটি বিষয় হচ্ছে, তাদের প্রাক্তন ছাত্র এবং ফ্যাকাল্টি মধ্যে সাতজন নোবেলজয়ী বিজয়ী হয়েছেন।
হাসানদের কাছে জানতে পারি, এখানে ৩১ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী পড়াশুনো করে ৷ এর মধ্যে ১৪০টি দেশ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বিদেশী ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে৷ ৫৩০ জন অধ্যাপক এবং তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করছে আরো পাঁচ হাজার মানুষ৷ ১০০ টির বেশী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ রয়েছে ৷
আমাদের সাথে আসা শিক্ষার্থীদের একজন সাগর এখানে পড়ছে রেডিও এন্ড ইনফ্রারেড এস্ট্রোনমি বিষয় নিয়ে । জীবনে প্রথম শুনি এরকম বিদঘুটে একটি সাবজেক্টের নাম! সাগর জানালো,বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয় নিয়ে গবেষণার জন্য বিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি৷ মলিকিউলার বায়োটেকনলজি বিষয় নিয়ে মাস্টার্স করা যায় এবং তাও ইংরেজিতে৷
রাজবাড়ির মতন বিশাল বিশাল ভবনে একেকটি ডিপার্টমেন্ট।ক্যাম্পাসের মাঠে পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদে মিনহাজরা দুই দলে ভাগ হয়ে ফুটবল খেলতে নেমে পড়ে। হাসানের সাথে আমি ক্যাম্পাসের ভেতর লাইব্রেরী ঘুরে ঘুরে দেখি। অনেক শিক্ষার্থীকে দেখলাম গভীর মনযোগ দিয়ে বই পড়ছে, নোট নিচ্ছে। চারিদিকে সুনশান নিরবতা। ছাত্র শিক্ষকদের জন্য এখানে গভীর রাত পর্যন্ত লাইব্রেরী ওয়ার্ক করার সুবিধা রয়েছে। এই লাইব্রেরীতে একসময় কার্ল মার্কস দিন রাত সময় কাটিয়েছেন। মার্কসের স্মৃতিবিজড়িত লাইব্রেরীতে পা রেখে কি যে ভাললাগা অনুভুতি হয়!
এতো বড় ক্যাম্পাস ঘুরতে হলে অনেক সময় প্রয়োজন। আবার স্বল্প সময়ে কিছুই দেখা সম্ভব না। লাইব্রেরী ঘুরে আবার মাঠে এসে কিছুক্ষন মিনহাজদের খেলা দেখি। বাবু বা কার পরিবর্তে যেন মিনিট পনেরো আমিও খেলতে নেমেছিলাম।এ বয়সে এসে ফুটবলের পিছনে দৌড়ানো শরীর কেন মানবে?
এ দৌড়াদৌড়ির ফল পেয়েছিলাম হোটেলে ফিরে। সারা শরীর জুড়ে
ব্যাথা। ডিনার সেরে রুমে ফিরতেই গা গরম, পা ব্যাথায় কাহিল। রাতে শেষ পর্যন্ত ব্যাথায় জ্বর চলে এলো। গা কাঁপানো জ্বরে যখন কাবু, তখন মায়ের দেয়া নাপা এক্সট্রা’র উপর ভরসা রাখতে হলো। দেশ থেকে আসার সময় মা বরাবরের মতন আমার হ্যান্ডব্যাগের সাইড পকেটে কিছু এবং ল্যাগেজে কফ সিরাফসহ অনান্য ওষুধ নিজ থেকেই দিয়েছিলেন। আমি তখন না করেছিলাম, কি দরকার এগুলি বয়ে নিয়ে যাওয়া !
আহা! এখন দেখছি কি কাজেই না লাগছে মায়ের দেয়া ঔষুধ।
বন, জার্মান