মোস্তফা ফিরোজ
২০২০। বছরের শেষ দিনে এসে জাতীয় প্রেসক্লাবে চমৎকার একটা নির্বাচন হলো। নির্বাচনের ফলাফলটাও ভালো। এর কারণ হলো, নির্বাচনটা খুবই সুষ্ঠু হয়েছে। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ছিলো। দেশের বিভিন্ন নির্বাচনের আবহ নিয়ে যখন নানা রকমের বিতর্ক, তখন এই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ায় কোন পক্ষের মনেই কোন প্রশ্ন বা সংশয় সৃষ্টি হয়নি। এই জন্য নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। এই নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির ছাপ থাকার পরও সব পক্ষই এটি মেনে নেয়ার মানসিকতা দেখিয়েছে, তাই প্রতিদ্বন্দ্বী দুই পক্ষও সাধুবাদ পেতে পারে।
দেশে বড়ো দুই দল প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদ ভাগাভাগি করে পেয়েছে। গতবার এই দুটি পদই ছিলো একটি পক্ষের দখলে। সেই বিবেচনায় বিরোধী দল তৃপ্তি পেতে পারে। আর সরকারি দলের আশাহত হবার কথা। কিন্তু তারা বলতে পারবে, তাদের সময়ে একটা আদর্শ নির্বাচন হলো। আর বিরোধী দলের হতাশা, বছরের শেষ ভাগে এসে কিছুটা দূর হলেও হতে পারে।
কিন্তু জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচন নিয়ে এই যে দলীয় হিসেব নিকেষ কষা হয়, এটা কি ভালো? সম্মানের? আমার দৃষ্টিতে এসব মোটেও ভালো না। সাংবাদিকদের নির্বাচনে দলীয় রাজনীতির প্রভাব, কখনই ইতিবাচক না। অতীতে সাংবাদিকদের নির্বাচন যতোটা গৌরবজনক ছিলো, এখন ততোটাই অসম্মানজক। স্বীকার করি নিকট অতীতেও দলীয় প্রভাব ছিলো। কিন্তু একটা ভারসাম্য ছিলো। সাংবাদিক নেতৃত্বের নিজস্ব স্বকীয়তা ছিলো। ফলে, তারা বুক ফুলিয়ে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সামনে কথা বলতে পারতেন। নেতারাও সমীহ করতেন সাংবাদিক নেতাদের। এখন সম্ভবত এই ধারা অনেকটা দূর্বল হয়ে গেছে। এসবের জন্য আমরাই অনেকটা দায়ী। আমরা দিনে দিনে যতোনা পেশার প্রতি যত্নবান হয়েছি, তার চেয়ে দলীয় রাজনীতির দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়েছি। এতে দল হয়তো সংকীর্ণ অর্থে লাভবান হয়েছে, কিন্তু সাংবাদিকতা দূর্বল হয়ে পড়েছে। তাই এখন গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু পেশাদার সাংবাদিকদের শক্তি বাড়েনি। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের সময় প্রেসক্লাব চত্ত্বরে যেভাবে মিছিল শ্লোগান হয়েছে, তাতে এটা কি রাজনৈতিক দল না সাংবাদিক সংগঠনের আচরণ, সেটা পার্থক্য করা কঠিন ছিলো।
নির্বাচনকে সামনে রেখে ২/৩ দিন প্রেসক্লাবে গিয়ে বুঝলাম এই প্রতিষ্ঠান এখন সাংবাদিক আর রাজনীতিক দুইভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। এটা দুঃখজনক। এতোদিন এখানে আসতাম না, সেটাই মনে হয় ভালো ছিলো। আশ্চর্য, চোখের সামনে বদলে গেলো প্রেসক্লাবটা! আরো অবাক কান্ড যে, দলের ব্যানারে থেকেও অনেকের ভিতরে দলের প্রতি আনুগত্য দেখলাম না। বরং এখানে দলের চেয়ে ব্যক্তির স্বার্থ বড়ো করে প্রচার চলেছে। অনেকটা বিদ্যমান দলীয় রাজনীতির ধারা। নির্বাচনী প্রচারের সময় লক্ষ্য করা গেলো প্যানেলের জয়ের বদলে ব্যক্তির জয়ের জন্য কেউ কেউ উদগ্রীব। আবার দলীয় কোন কোন প্রার্থীকে হারিয়ে প্রতিপক্ষের প্রার্থীর জয়ের জন্য অনেকে তৎপর। ফলে, এখানে দলের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থের চর্চা চলেছে বিপুলভাবে। অথচ,উপরে উপরে তারাই আবার দলের জন্য নিবেদিত, এমন ভাবটা প্রকাশ করছে। নিজেদের ভিতরে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির প্রতিযোগিতা বলা যায়। এসব পরিবেশ না সাংবাদিকতা, না দলীয় রাজনীতি কোনটার জন্যই ভালো না। আর একটি হতাশার চিত্র এখানে উল্লেখ করতে চাই। নির্বাচন হলো। ফলাফল সবাই মেনে নিলো। কিন্তু ফলাফল ঘোষনার পর নির্বাচিত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ফটোসেশান করানো গেলো না। এখানেও এমন সব ইস্যু তুলে আনা হলো যা খুবই বেমানান। অনেক জাতীয় রাজনীতির মতোই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একসাথে বা পাশাপাশি দাঁড়াবে, সেতো এক অসম্ভব বিষয়! এখানেও তাই হলো।
যাক্। তারপরও বলবো ভালো নির্বাচন।
প্রেসক্লাবের এই নির্বাচনে কেউ কেউ দলীয় লাভ ক্ষতির হিসেব কেউ কষতে পারে। কিন্তু ভালো একটি নির্বাচন হওয়াতে সাধারণ মানুষের জন্য এটা আশাব্যাঞ্জক। ভালো একটা উদাহরণও বটে। দেশের জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনগুলো ভালো হচ্ছে না বলে প্রায়ই অভিযোগ উঠছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানে সাংবাদিকদের নির্বাচন হলো কোন রকমের বিতর্ক ছাড়াই। আবার এই নির্বাচন যারা পরিচালনা করলেন তারাও নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করলেন।
জাতীয় রাজনীতির নানা রকমের হতাশার বিপরীতে বছরের শেষে এবং নতুন বছরের শুরুতে জাতীয় প্রেসক্লাবের এই নির্বাচন কিছুটা আলো ছড়িয়েছে। এটাও বা কম কি!