মাসুদুল হাসান রনি, কানাডা থেকে
রবিবার রাতে খবরটি শুনে ভীষন মন খারাপ হয়েছিল।সারাটা রাত ঘুমুতে পারিনি। একজন নির্লোভ, সৎ, সরল মানুষের না ফেরার দেশে চলে যাওয়ায় জন্য বুকটা হু হু করেছে। বারবার ঝাপসা হয়ে অাসা দু’চোখ মুছেছি। বাহারভাই, আপনিও চলে গেলেন!
একে একে প্রিয় মানুষগুলো চলে যাচ্ছেন। না ফেরার দেশে চলে যাওয়া সর্বশেষ নামটি যুক্ত হলো অভিনেতা মহিউদ্দীন বাহার। আমার প্রিয় বাহারভাই।
আমি দেশে ফিরে এলে আর দেখা হবে না, ফোনে দীর্ঘ সময় কথা হবে না। কাকরাইল -বিজয়নগর গেলে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে ঢুঁ মারা হবে না। দয়াগঞ্জ যাওয়া হলে ফোন দিয়ে বিরক্ত করা হবে না, অাসেন চা খেতে খেতে অাড্ডা দেই। আমার নাটকের সেটে শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে গল্প, একুশে টিভির ক্যান্টিন, আমার রুমে অাপনার সাথে আড্ডার কত শত স্মৃতি। এসব আমাকে সারাটা রাত ঘুমুতে দেয়নি। অথচ আপনি কত নিশ্চিন্ত একটি অনন্তযাত্রায় ঘুমিয়ে গেলেন!
২.
বাহারভাইকে চিনি সেই কৈশোরের দিনগুলো থেকে। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী সিনেমা দেখে।সেই বাহারভাইয়ের সাথে পরিচয়পর্বটা হয়েছিল ২০০৩ সালে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সহজ-সরল মানুষ। ছোটবড় সব মানুষকে সম্মান করতেন। অত্যন্ত সাদামাটা আটপৌড়ে জীবন যাপন অভ্যস্ত ছিলেন। অথচ এই মানুষটি
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সুনামের সাথে কাজ করেছেন, সিনিয়র সহকারী সচিব ছিলেন। তার আচার আচরনে তা কখনোই প্রকাশ পেত না। ২০০৫ সালে সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নেন এই অভিনেতা। খুব কাছ থেকে দেখেছি বলেই জানি, বাহারভাই ছিলেন একজন সৎ, নীতিবান আদর্শ সরকারী কর্মকর্তা।
দীর্ঘ ৪০ বছর তার অভিনয় জীবন। মঞ্চের মাধ্যমেই তার অভিনয় শুরু । মহিউদ্দিন বাহার প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন ১৯৬৭ সালে। জাকারিয়ার পরিচালনায় নাটকটির নাম ছিল ‘বিশ বছর পর’। অবশ্য তিনি অভিনয় শুরু করেছিলেন আরো আগে। যখন স্কুল ছিলেন। ১৯৬২ সালে মঞ্চস্থ নাটকটি ছিল একটি ইংরেজি নাটক, নাম ‘মানকিজ প’। ১৯৭৬ সালে যোগ দেন নাগরিক নাট্যদলে। এ দলের হয়ে অভিনয় করেছেন ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’, তৈল সংকট’সহ অনেক নাটকে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’তে অভিনয় করেছেন তিনি। কাজ করেছেন ‘আমি কার’, ‘ছিনতাই’, ‘তুমি আসবে বলে ভালবাসবে বলে’ ও ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রে। ১৯৭৭ সালে বিটিভির ‘রোজ রোজ’ অনুষ্ঠানে নিয়মিত অভিনয় করেছেন। বিটিভির জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান প্রয়াত ফজলে লোহানীর ‘যদি কিছু মনে না করেন’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবার নজর কাড়েন তিনি। দর্শকপ্রিয় ‘ইত্যাদি’ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে অভিনয় করেছেন দীর্ঘ ২৫ বছর।
একদিন একুশে টিভির দশতলায় ক্যান্টিনে আড্ডায় তাকে জিগেস করেছিলাম, ছোট ছোট স্কীডে অভিনয় করে দীর্ঘ সময় জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন।
স্বভাবসুলভ হেসে বলেছিলেন,ভাই রনি, ঠিকই বলছো।
সমাজের অসঙ্গতি, অন্যায়, অবিচার তুলে ধরা ও জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারলে দর্শক গ্রহন করবে। হানিফ সংকেতের ইত্যাদী এর প্রমান এবং জনপ্রিয়।”
৩.
২০০৭ সালে একুশে টেলিভিশনের জনপ্রিয় লাইভ একুশে দুপুর অনুষ্ঠানে প্রথমবার যখন এলেন তখন বাহারভাই সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছেন। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের অবৈতনিক পরিচালক।
সেদিন অনুস্টান শেষে ক্যান্টিন আড্ডায় বাহারভাই আমাকে বলেছিলেন, ঈদের জন্য ম্যাগাজিন অনুস্টান করেন। আমি, আনিসভাই থাকব।
-ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মান খুব ঝামেলার কাজ। এতো আয়োজন থাকে, তারচেয়ে বরং নাটক নির্মানের আয়োজন অনেক সহজ।
আমার কথা শুনে বাহারভাই কিছুটা হতাশ হয়েছিলেন।
তার এই হতাশামাখা মুখ দেখে বলেছিলাম, যান আমি প্রথমবারের মতন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান বানাবো। আপনি অবশ্যই থাকবেন।
বাহারভাইয়ের জন্য সেই বছর ঈদুল ফিতরে আমার প্রযোজনায় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ”বোগাস প্লাস বোগাস ” বানিয়েছিলাম। বাহারভাই ও বিখ্যাত অভিনেতা আনিসভাই দু’টো স্কীডে অভিনয় করেছিলেন। পরের ঈদে সিক্যুয়াল বানিয়েছিলাম বোগাস আনলিমিটেড। সেখানেও তিনি অভিনয় করেছেন
পরের বছর ঈদুল আজহায় মাজহার খোকনের কাহিনী ও চিত্রনাট্যে আমার পরিচালনায় “পুরুষ আশ্রম” নাটকে বাহারভাই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ২০১০ সালে তিনি আমার পরিচালনায় , সাহিত্যিক সারওয়ার-উল- ইসলামের চিত্রনাট্য “ধান্ধা” নাটকে অভিনয় করেন। এই নাটকে তিনি একজন ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তার চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন।
নাটকের সেটে অবসরে তিনি সহশিল্পীদের হাস্যরসে মাতিয়ে রাখতেন। সেটে শ্যুটিং নিয়ে কোন কারনে যদি আমার মন খারাপ থাকতো, তিনি বুঝতে পেরে পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলতেন,ভাই রনি, ‘জীবনে উত্থান পতন আছে। এগিয়ে যেতে হলে মনোবল সাহস রাখতে হয়।’
৪.
মহিউদ্দিন বাহারের জন্ম ফেনীতে। বেড়ে উঠেছেন ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুল ও নটরডেম কলেজে। ১৯৭২ সালে বিয়ে করেন মাহাবুবা আক্তার মমতাকে। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার ছিল। দয়াগঞ্জে তার বাসা। এলাকার মানুষজনের কাছে ছিলেন অসম্ভব ভাল মানুষের প্রতিকৃতি।
তিনি আড্ডায় প্রায় বলতেন, ‘সততা ও শিক্ষা ছাড়া উন্নতি অসম্ভব’।
সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কিংবা ব্যক্তিজীবনে কখনো তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। কর্মজীবনে তিনি কখনো অভিনয়ের জন্য অফিস ফাঁকি দেননি।
৫.
অনেক কথাই মনে পড়ছে। কিছুই গুছিয়ে লিখতে পারছি না। বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।২০১৮সালে আপনার দীর্ঘ লাইফ সাপোর্ট থেকে আসার পর একদিন ফোনে দুঃখ করে বলেছিলেন, ভাই রনি, হানিফ সংকেত ছাড়া আমার সহশিল্পীরা কেউ খোঁজ নেয়নি। একদিন আমার মতন হয়তো তাদের একই অবস্থা হবে।তারা আমার মতন কস্ট পাবেন। আসলে শিল্পীদের সুখের সময় নয়, দুঃখ কস্টের সময় পাশে সহকর্মীদের পাশে থাকা উচিত। “
হ্যাঁ, বাহারভাই, আপনার কথাটি সত্য। সুসময়ে শুধু নয় দুঃসময়ে যে পাশে থাকেন সেই প্রকৃত বন্ধু।
১৪.০৯.২০২০
মন্ট্রিয়েল